Skip to content

আনাসের কথা

আনাসের গল্পটা কয়জন জানে?

কেউ চাইলে অবশ্য ব্যাপারটা এক লাইনেই বলে ফেলতে পারে। আনাস ফেরদৌস দিনাজপুর জেলা স্কুলের ছেলে, সে ২০১৫ সালে বিজ্ঞান জয়োৎসবে সারাদেশের মধ্যে চ্যাম্পিয়ন হয় এবং একইসাথে চিলড্রেন সায়েন্স কংগ্রেসেও বিজয়ী হয়।

…ব্যস, শেষ?

না, এখানেই শেষ না। এই এক লাইনের পেছনে আছে দীর্ঘদিনের একটা গল্প। আনাস নিজেই লিখেছে প্রজেক্ট নিয়ে তার কাজ করার অভিজ্ঞতার কথা।

গল্পটা পড়ে ফেলা যায়!

আনাসের কথা

আবিষ্কার আর উদ্ভাবন—এই শব্দ দুটো আমার কাছে আগে সাধারণ মনে হত, কিন্তু এখন এগুলোর আসল মানেটা ধীরে ধীরে বুঝতে পারছি। আসলে আমার উদ্ভাবনের গল্পের শুরুটা নিতান্তই মজার। সেখান থেকে অনেক চড়াই উতরাই পার হয়ে অবশেষে আমি কিছু একটা বানাতে পেরেছি যা একান্তই আমার, এবং পৃথিবীতে এটি আমিই প্রথম তৈরি করেছি। এই ভালোলাগাটুকু এমন একটি অনুভূতি যা অন্য কোন কিছুর সাথে তুলনা করা যায় না।

যা হোক, আর কথা না বাড়িয়ে আসল কথায় আসি। একদিন আমার বাথরুমে রাখা অর্কিড থেকে বাজে একটা গন্ধ আসছিল (অনেকটা ইউরিনের মত)। আমার সন্দেহ আমার ছোট ভাইয়ের প্রতি, আমি ভেবেছি সেই এই কাজটি করেছে। কিন্তু তার ভাষ্য হচ্ছে সে গাছটায় কিছু করে নি! কিছুদিন পর আমি গাছটি পরিষ্কার করতে এসে দেখি গাছের গোড়ায় রসুনের পাতা রয়েছে (সম্ভবত আমি লাগানোর সময় দিয়েছিলাম)। আর সেখান থেকে তীব্র গন্ধ বের হচ্ছিল। একদিন এর কারণ খুঁজতে গিয়ে রসুনের পাতা পানিতে ভিজালাম, ওমা! সেই একই গন্ধ। তখন বুঝতে পারলাম আমার ভাইটা নির্দোষ।

কারণ জানতে চাওয়ার অদম্য সেই কৌতূহল থেকেই মূলত আমার কাজের শুরু।

এরপর শুরু হল পড়ালেখা। বই-ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি করে জানতে পারলাম যে রসুনে নাকি কিছু সালফার যৌগ আছে যার জন্য এমনটি হয়, আর এই যৌগ নাকি পোকামাকড়, ব্যাক্টেরিয়া মারার ক্ষমতা রাখে। ব্যস, আমি ভেবে নিলাম এখান থেকে আমি কীটনাশক বানাবো। তারপর কাজ থেমে থাকলো কয়েক মাস, এর মধ্যে বোতলে জমানো রসুনের পাতা ভিজানো পানি রেখে দিয়েছিলাম জানালার পাশে। মাসখানেক পর দেখি তার রঙ পালটে গিয়েছে। আমার কৌতুহল বাড়লো, আমি সেই পানিটা ফেলে না দিয়ে আমার একটা যেনতেন গাছের গোড়ায় দিয়ে দিলাম। যা ঘটল তা একটা ম্যাজিকের চেয়ে কম ছিলো না, আমার সেই রোগা গাছে প্রাণ ফিরে এলো, আর ফুলও ফুটলো! এরপর আমার মনে হল, এখান থেকে আমি সারও বানাতে পারবো।

এরপর একদিন আমাদের এলাকায় চিলড্রেন সায়েন্স কংগ্রেসের প্রস্তুতিমুলক ক্যাম্প ও কর্মশালা হলো। পরিচয় হলো চিলড্রেন সায়েন্স কংগ্রেসের একাডেমিক কোঅর্ডিনেটর জুনায়েদ ইসলাম জজ ভাইয়ার সাথে। সেখানে আমার বিভিন্ন প্রশ্ন ও এই মজার ঘটনা নিয়ে কথা বললাম এবং কংগ্রেস সম্পর্কে শুনে আগ্রহী হলাম। ভাবলাম আমি এটা নিয়ে কাজ করবো এবং তারপর কংগ্রেসে সেটা দেখাবো। ক্যাম্প ও কর্মশালায় এই বিষয়ে আলাপ করলাম, ভাইয়ার মাধ্যমে জানতে পারলাম আমাকে কীভাবে কাজ করতে হবে, কী কী তথ্য সংগ্রহ করতে হবে, কীভাবে পরীক্ষা করতে হবে ইত্যাদি। এরপর আমি কাজে লেগে পড়লাম। কাজের জন্য আমি বিভিন্ন কৃষকের কাছে যেতাম, সারের দোকানে যেতাম তথ্য সংগ্রহ করতে। নিজের বাড়ির সামনের জমিতে মটরশুঁটি, পিয়াজ লাগালাম, আর বারান্দায় টবে লাগালাম গম। এভাবে সেগুলোর উপর আমার সার কীটনাশক প্রয়োগ করে দেখছিলাম আর ডাটা কালেক্ট করছিলাম।

এভাবে কাজ করতে করতে একদিন আমি কলার খোসার বায়োপ্লাস্টিক সমন্ধে শুনি। আমি ভাবলাম, তাহলে কি রসুনের পাতা থেকে প্লাস্টিক বানানো যাবে না? আবার শুরু হল পড়াশুনা, অবশেষে আমি রসুনের পাতা থেকে স্টার্চ সংগ্রহ করার একটা পদ্ধতি বের করতে পারলাম। আমাকে এর জন্য প্রায় ২৩ টি এক্সপেরিমেন্ট করতে হয়েছিলো। তাও হার মানি নি। আবার প্লাস্টিক তৈরি করতে মহাসমস্যা হচ্ছিল কারণ আমার না ছিলো ল্যাবের কোন যন্ত্রপাতি, না ছিলো ভালো মানের রাসায়নিক। বাড়ির হাঁড়িপাতিলে অসংখ্যবার চেষ্টা করার পর আমি একটা ব্যবহারযোগ্য স্যাম্পল তৈরি করতে পেরেছিলাম। অবশ্য এজন্যে মায়ের বকুনি কম খেতে হয় নি!

এমন সময় চলে এলো বিজ্ঞান জয়োৎসব এর আঞ্চলিক পর্ব। আমি আর আমার কয়েকজন বন্ধু সেখানে আমার কাজগুলো নিয়ে গেলাম। মুনির হাসান স্যার এবং অন্যরা আমার কাজ দেখে অনেক খুশি হলেন, বিশেষ করে প্রধান অতিথি অনেক বেশি খুশি হয়েছিলেন। তখন মুনির হাসান স্যার আমাকে সাহায্যের আশ্বাস দিলেন। আমি জাতীয় প্রতিযোগিতার জন্য নির্বাচিত হলাম। বাড়ি ফিরে পূর্ণ উদ্যমে কাজে লেগে পড়লাম, পড়ার ফাঁকে চলত আমার কাজ। এদিকে জুনায়েদ ভাইয়াসহ এসপিএসবির আরো কয়েকজন মেন্টরের কাছ থেকে মাঝে মাঝে পরামর্শ নিতাম।

একদিন আমার এক বন্ধু বলল, চল আনাস এবার এখান থেকে জ্বালানি বানাই। কথাটা আমি প্রথমে উড়িয়ে দিলাম। পরে বাড়ি ফিরে ভাবলাম বুদ্ধিটা মন্দ নয়। সব বন্ধু মিলে জ্বালানি তৈরির উপায় নিয়ে শুরু করলাম পড়াশোনা আর গবেষণা। প্রথমে ভাবলাম রসুনের পাতার সালফারকে অপসারণ করে হাইড্রোকার্বন তৈরি করবো। কিন্ত কোনভাবেই তা পারলাম না। এরপর আমি একটু অন্যভাবে চিন্তা করলাম। আমি ভাবলাম রসুনের পাতা থেকে কিছু উপাদান আলাদা করে সেখান থেকে জ্বালানি বানাই। এরপর আমি পাতা থেকে স্টার্চ আর পেক্টিন আলাদা করার উপায় পেয়ে গেলাম। কিন্ত তা আদৌ সহজ ছিলো না, প্রায় সাড়ে তিন মাসের মত লেগে গিয়েছিল তা করতে।

এরপর স্টার্চ থেকে ইথানল আর পেক্টিন থেকে মিথানল বানানো হল। জুনায়েদ ভাইয়ার সাথে যোগাযোগ করলাম, ভাইয়া বলল যে জ্বালানিটা ব্যাবহার করে দেখতে হবে। আমি পড়ে গেলাম চিন্তায়, কোথায় ব্যবহার করবো? এরপর আইডিয়া এল যে শ্যালোমেশিনে ব্যবহার করা যায়। নানীবাড়ি চলে গেলাম, সেখানে টাকা দিয়ে একটি শ্যালোমেশিন ভাড়া করা হলো। মেশিন সেট করে আমার তৈরি জ্বালানি দেয়া হল, প্রথমে মনে হল চলবে না, বুক ধুক ধুক করছিল। একটু পরে যখন মেশিন থেকে ঘরঘর শব্দে পানি বের হওয়া শুরু হল তখন আমার জীবনের সেরা চিৎকারটা দিয়েছিলাম!

এইবার পরের ধাপ। আমি আমার দ্রব্যগুলো ব্যবহার করে তার কার্যকারিতা, খরচসহ অন্যান্য দিকের তুলনা করে ডাটা কালেক্ট করতে লাগলাম। এরপর এলো কংগ্রেস। কাজ সব শেষ করে চলে গেলাম শেখানে, পেপার জমা দিলাম, আর ভাগ্যক্রমে পেয়েও গেলাম একটা পুরস্কার। এরপর ডাক পড়লো জগদীশ চন্দ্র বসু ক্যাম্পে। সেখানেও চলে গেলাম। মাত্র তিনদিনের আবাসিক ক্যাম্পে যে কত কিছু সেখানো হয় আর কতগুলো নতুন বন্ধু বানানো যায় সেটা ক্যাম্প না করলে বোঝা সম্ভব না। জীবনের সেরা তিনটি দিন কাটিয়েছিলাম সেখানে। ক্যাম্পের ফারসীম স্যারের ক্লাস, মুনির হাসান স্যার এর মেজারমেন্ট খেলার ক্লাস, রাত জেগে আড্ডা, বারবিকিউ পার্টি, জীন বিজ্ঞানী আবেদ স্যার এর ক্লাস, নতুন পোস্টার তৈরি, বাস্তবিকই কিভাবে গবেষণা হয় তা দেখা—এসব ছিলো এককথায় অসাধারণ! ক্যাম্পে আমার প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করার বেশ কিছু দিক নির্দেশনাও পেলাম। বাসায় এসে এসএসসির পড়াশুনা, তবুও কাজ থামালাম না। নতুন করে মিথানল তৈরির কাজ করতে লাগলাম। অনেকদিন চেষ্টা করার পর সেটি সহজে এবং সাশ্রয়ী উপায়ে তৈরি করার একটি পদ্ধতি বের করতে পারলাম।

দেখতে দেখতে ডিসেম্বর চলে আসলো, সায়েন্স কার্নিভাল এর জাতীয় উৎসবের তারিখ দিয়ে দিল। আমিও আমার পুরো প্রস্তুতি নিতে থাকলাম। আমার প্রজেক্টের কিছু রসায়নবিষয়ক সমস্যা ছিল যার জন্য আমি এসপিএসবির মেন্টর শাফিন ভাইয়া আর জামী ভাইয়ার সাহায্য নেই। সব কিছু ঠিকঠাক করে চলে গেলাম ঢাকা। জাতীয় উৎসবের প্রথম দিনটা ছিল একটু ভয়ের, কারণ ঐ দিন বিচারক আসার কথা ছিলো। আমার প্রজেক্টটা দেখতে অনেক সাধারণ ছিলো। অন্য প্রতিযোগিরা হেসেই উড়িয়ে দেয়। কিন্ত এরমধ্যেই প্রজেক্টটি সারা ফেলে দিয়েছিলো। যখন মাননীয় বিজ্ঞানমন্ত্রী এলেন তখন মুনির হাসান স্যার তাকে আমার কাজ নিয়ে বললেন, মাননীয় মন্ত্রী আমাকে এটা নিয়ে জাতীয়ভাবে কাজ করার আশ্বাস দিলেন। এরপর এলেন বিচারকরা। এসে অনেকগুলো প্রশ্ন করলেন, আমি নিজে কাজ করায় আমি জানতাম সবকিছুই। সবশেষে ফারসীম স্যার মজা করে বললেন, আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলো তো সব কাজ তুমি করেছো! স্যারের এটা সাইকোলজির ব্যাপার ছিলো। যা সত্য তাই বললাম, আমি কাজ করেছি, শেষ।

পরের দিন ফলাফল। আমি বেশ ভয়ে ভয়ে ছিলাম। পুরস্কার দেয়ার সময় যখন একে একে সব দেয়া শেষ হল তখন ভাবলাম আমি মনে হয় আর নেই। এরপর সবার শেষে যখন আমার নাম চ্যাম্পিয়ন হিসেবে ডাকলো আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। কারণ এত বড় একটা প্রতিযোগিতার জাতীয় পর্যায় বলে কথা। এই পুরস্কার পাওয়ার পর তো উৎসাহ উদ্দীপনা আরো বেড়ে গেলো। এরপর লক্ষ্য ছিলো গুগল সায়েন্স ফেয়ার। আমার এসএসসি চলে এলো। পরীক্ষার সময় সব বন্ধ রাখলাম। পরীক্ষাশেষে জুনায়েদ ভাইয়ার ফোন পেয়ে আবার কাজ শুরু হলো। গুগল সায়েন্স ফেয়ারের জন্য প্রজেক্ট গোছাতে লাগলাম। ভাইয়া ছিলো আমার প্রজেক্টের মেন্টর। একেবারে দিনে ৭-৮ ঘন্টা করে কাজ করলাম। প্রজেক্টটা ইংরেজিতে ট্রান্সলেট করা, রেফারেন্স সাজানো, আরো অনেক কিছু। একেবারে শেষ সময়ে এসে প্রজেক্টটা গুগলে সাবমিট করতে পারলাম। ব্যস, এটুকুই।

আসলে আমার কাজের শুরু একটা ফেলে দেয়া পাতা থেকে বেশি কিছু ছিলো না। না ছিলো টাকা, না ছিলো যন্ত্রপাতি, না ছিলো পরিবারের কারো সাপোর্ট। এই কাজের জন্য আমার বাড়ি থেকে কত যে বকা খেতে হয়েছে সেটা আর নাই বলি। আসলে আমার ছিলো কাজ করার অদম্য ইচ্ছা, আর একদল মানুষ যারা আমাকে উৎসাহ দিয়েছে (বাংলাদেশ বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণ সমিতির ভাইয়ারা), আমার পাশে ছিল আমার এক বন্ধু মেহেদী হাসান জিহাদ, যে প্রজেক্ট এর কাজ না করলেও আমাকে দিয়েছে অনুপ্রেরণা। এভাবে আমার কাজ গুগল পর্যন্ত যেতে পেরেছে। আমি জানি না যে আমার প্রজেক্ট গুগল সায়েন্স ফেয়ারে নির্বাচিত হবে কি না, কিন্তু আমার কাছে এটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়। আসলে এই আবিষ্কারের আনন্দটুকুই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। নতুন কিছু করার এই আনন্দ যে একবার পেয়েছে সেই শুধু এর মর্ম বুঝবে। নিজের তৈরি জ্বালানি দিয়ে শ্যালোমেশিন থেকে পানি পড়তে দেখার সময় এতবড় চিৎকারের সাথে আমার চোখ থেকেও দু ফোঁটা আনন্দের অশ্রু হয়তো পড়েছিল। সেটুকুর দাম বিশ্বের অন্য কোন কিছু দিয়েই দেয়া যাবেনা!

আর কী? সবশেষে একটা কথা বলতে চাই, যে কোন কিছু নিয়ে কাজ কর না কেন, যত বাধাই আসুক না কেন, শুধু হাল ছেড়ো না।

সুন্দরের স্বপ্ন দেখা সব মানুষকে শুভকামনা!