আমাদের স্বপ্নের MASLAB নিয়ে কয়েকদিন ধরেই ফেসবুকের ইনবক্সে রীতিমত ঝড় যাচ্ছে। কেউবা বাহবা দিচ্ছেন আবার কেউ কেউ এর ভবিষ্যৎ নিয়ে এখন থেকেই উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। তবে সবচেয়ে বেশি মনকে নাড়া দিচ্ছে কিছু স্কুল পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের আনন্দ-উচ্ছ্বাস দেখে। টিম এসপিএসবির প্রায় সব একাডেমিক মেম্বারের ফেসবুক ইনবক্সের অর্ধেকটা জুড়েই এই পিচ্চিগুলি সারাবছর দৌড়াদৌড়ি করে। ওদের প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে আমাদেরও অনেক কিছু জানা হয়ে যায়। মজা করে আমরা এটাকে বলি “ পিচ্চি অ্যাটাক করছে” । এই যেমন কয়েকদিন আগে এক পিচ্চির প্রশ্ন ছিল “ আগুন কি পদার্থ নাকি অপদার্থ!! ” প্রশ্নটা কিন্তু অনেক মজার। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে সে শিক্ষককে এই প্রশ্ন করে সবার সামনে অপদার্থ বলে অপমান হয়। ক্লাস সিক্সে পড়া সেই পিচ্চি রাগে ক্ষোভে পরের দুইদিন স্কুলে যেত বটে কিন্তু ওই স্যারের ক্লাস করেনি। আমাদের কাছে প্রতিদিন এরকম অনেক মজার মজার প্রশ্ন আসে। “ ব্লাকহোল আছে কিন্তু যদি আরেকটা ব্লাকহোল তৈরি হয় তাহলে কি সেটার নাম সাদাহোল দেয়া হবে? ”  এটার উত্তর এখনও দেইনি কারণ আজ সকালেই পেয়েছি।

এই পিচ্চিগুলি আসলে সারাবছর বাবিজসের বিভিন্ন আয়োজনে অংশগ্রহণ করে। কেউবা কংগ্রেসের ক্যাম্পে ছিল আবার কারো স্কুলে আমরা কোন একটা কর্মশালা নিতে গিয়েছিলাম। এভাবেই তাদের সাথে কানেক্ট হয়ে যাওয়া। আজকে এই ব্লগটা লেখার উদ্দেশই হল বাবিজস সম্পর্কিত কিছু প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দেয়া।

“ আচ্ছা ভাইয়া বাবিজস বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানভীতি দূর করার জন্য এতো ভালো ভালো কাজ করে অথচ ল্যাবের এই সামান্য চার লাখ টাকা ম্যানেজ হচ্ছেনা। এমনিতেই তো তোমরা বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের কাজে লক্ষ লক্ষ টাকার প্রোগ্রাম আয়োজন করো, তবুও কেন  MASLAB সেটআপে তোমরা টাকা খরচ করতে পারতেছ নাহ? আসলে এটা মেনে নিতে পারতেছিনা। নাচ,গান কিংবা লোক দেখানো অনেক রিয়্যালিটি শোতে তো ঠিকই বিভিন্ন কোম্পানি টাকা ঢালতেছে কিন্তু এই মহৎ উদ্যোগে কাউকে পাওয়া যাচ্ছেনা কেন? ”

আসলে পাওয়া যাচ্ছেনা বললে ভুল হবে, মানুষ অনেক আছে কিন্তু পাগল মানুষ পাওয়া যাচ্ছেনা। মুনির স্যারের ভাষায় আমরা সবাই পাগল। জি আমরা আসলেই পাগল, তা না হলে কি একজন সুস্থ মানুষের পক্ষে নিজের বাপের খেয়ে বনের মহিশ তাড়ানো সম্ভব? মনে হয়না সম্ভব। বাবিজস পুরোটা একটি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান। এখানে যারা কাজ করে তারা কেউই কোনদিন কোন টাকাপয়সা পায়নি, ভবিষ্যতেও পাবেনা। যারা এই মতবাদে বিশ্বাসী তারাই কেবল বাবিজসে কাজের সুযোগ পায়। এখন প্রশ্ন হতে পারে এই স্বার্থের দুনিয়ায় এটা কিভাবে সম্ভব? সম্ভব আসলেই সম্ভব, ওই যে বললাম আমরা পাগল। সেই জন্যই সম্ভব।

বাবিজসের বিভিন্ন প্রোগ্রামগুলির খরচ স্পন্সরদের টাকায় হয়ে থাকে। প্রোগ্রাম অনুযায়ী টাকার পরিমাণ নির্ধারণ হয়। কিন্তু এখন এমন পরিস্থিতি হয়েছে যে প্রোগ্রাম অনেক, আইডিয়া অনেক কিন্তু টাকা দেয়ার মানুষ নাই। বিগত এক বছর ধরে আমাদের বড় কোন প্রোগ্রামের স্পন্সর নাই। “ যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে ” নীতিতে আগাচ্ছি। আমরা এখন যেকোনো আয়োজনের প্ল্যান করার সময়ই তিন ক্যাটাগরির প্ল্যান করি। স্পন্সর বড় পেলে প্ল্যান এ, ছোট পেলে প্ল্যান বি আর কাউকে না পেলে প্ল্যান সি। প্ল্যান সি হল নিজেদের জমানো টাকা দিয়ে প্রোগ্রাম করে ফেলা।

গেলবছর শিশুকিশোর বিজ্ঞান কংগ্রেস কিংবা বাংলাদেশ জুনিয়র সায়েন্স অলিম্পিয়াড কোন আয়োজনেরই স্পন্সর ছিলনা । কিন্তু আমরা বাংলাদেশ ফ্রিডম ফাউন্ডেশনের সাথে যৌথ উদ্যোগে এই দুটি বিশাল আয়োজন করে ফেলিছি। যতদূর জানি এবছরও আমাদের এই বিশাল প্রোগ্রামগুলির কোন স্পন্সর নেই। অথচ বাংলাদেশ জুনিয়র সায়েন্স অলিম্পিয়াড থেকে বাংলাদেশ দলের সদস্য ফারহান ইন্টারন্যাশনাল জুনিয়র সায়েন্স অলিম্পিয়াডে যেয়ে ব্রোন্স অর্জন করে। প্রথমবার অংশগ্রহণেই ব্রোন্স। কিন্তু এই অর্জনের পেছনের গল্পগুলি ছিল অনেক ত্যাগের। বাজেট না থাকাতে অফিসে বসে বসে ফারহানদের ট্রেইনিং ক্যাম্প করানো হয়েছিল । বাংলাদেশ দল সবার নিজ নিজ খরচে লাল-সবুজের পতাকা নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়া পাড়ি দিয়েছিল।

অন্যদিকে কংগ্রেসের ক্যাম্পগুলিও কাটছাট করে করতে হয়েছে। তিনদিনের জায়গায় দুইদিন, দুইদিনের জায়গায় একদিন। গেলবছর আমাদের আইজেএসও টিমের ল্যাব ক্লাস হয়েছেই মোটে ১/২ টা। আমরা চাইলেও বেশি করাতে পারিনি শুধুমাত্র নিজেদের ল্যাব না থাকার কারণে। বুয়েট, ঢাবিসহ দেশের সব স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই বিজ্ঞান ল্যাব আছে কিন্তু একাডেমিক শিডিউল ব্রেক করে তো আর আমরা যখনতখন যেয়ে কিছু একটা টেস্ট করে দেখতে পারবনা।

তাই স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম কবে একটা নিজেদের ল্যাব হবে, যেখানে আন্তর্জাতিক জুনিয়র সায়েন্স অলিম্পিয়াডে যে বাংলাদেশ দল যাবে, তারা এই ল্যাবে এক্সপেরিমেন্ট করবে। স্কুলের কোন একটা ছেলে বা মেয়ে বিজ্ঞান কংগ্রেসের প্রজেক্টের জন্য যে এক্সপেরিমেন্টটা স্কুলের টিচারের চোখ রাঙানির ভয়ে স্কুলের ল্যাবে করতে পারছে না, নাহয় স্যারকে বলতে সাহস পাচ্ছে না, সে এই ল্যাবে এসে নিজে নিজে সেটা করে যাবে। স্কুলের বাচ্চাদের জন্য আমরা যখন কোন এক্সপেরিমেন্ট দেখানোর প্রোগ্রাম করবো, এই ল্যাবে বসেই সব টেস্ট করবো, নতুন এক্সপেরিমেন্ট তৈরি করবো, মাঝেমাঝে দুই-একটা বিস্ফোরণও এই ল্যাবে ঘটিয়ে ফেলবো। এই সবই আমাদের স্বপ্ন। অনেকদিনের স্বপ্ন।

আসলে মাকসুদুল আলমের মতো বিজ্ঞানীরা তো এই দেশে এভাবেই তৈরি হবে। জিনবিজ্ঞানি মাকসুদুল আলমের নামে এই ল্যাবে বাচ্চাকাচ্চারা যে শুধু এক্সপেরিমেন্ট করবে, তা না, তারা স্বপ্ন দেখবে। তারা স্বপ্ন দেখবে একজন গবেষক হওয়ার, সত্যিকারের বিজ্ঞানী হওয়ার। স্বপ্ন বাস্তবায়নের কাজে নেমে পড়লাম সাথে সাথে ল্যাব করার জন্য একটা জায়গাও পেয়েছি। ফারসীম স্যার এর বাসার নিচতলায় ৪০০ স্কয়ার ফিটের একটা ফ্ল্যাট। ফ্ল্যাটটা এখন খালি। হুম, আসলেই খালি। ল্যাবের সফিসটিকেটেড সব যন্ত্রপাতি আমরা কিনে নিয়ে গিয়ে সব ঠিকঠাকভাবে সেট আপ করলে তারপরেই না আমাদের স্বপ্নের ল্যাবটা দাঁড়াবে। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল একটা জায়গাতেই, এই ল্যাব তৈরির জন্য যেসব ইনস্ট্রুমেন্ট প্রয়োজন হবে, সেসব কেনার জন্য প্রায় চার লাখ টাকা প্রয়োজন। টাকা পাওয়া যাবে কোথা থেকে? আমাদের তো টাকা নাই, কিভাবে হবে এই ল্যাব?

কি আর করা, পাগল যে আমরা তাই তৈরি হয়ে গেল প্ল্যান সি,নিজেদের যা আছে তাই দিয়েই ১লা মে আমাদের ল্যাব ওপেন হবে,হয়ত ভাঙ্গা চেয়ার-টেবিল দিয়েই আমাদের স্বপ্নের ল্যাবের যাত্রা শুরু হবে।

ল্যাব তো আমাদের দাঁড়াবেই। এখন আপনি আমাদের সাথে থাকবেন কিনা, ভেবে দেখেন।

ল্যাব নিয়ে বিস্তারিত জানা যাবে আমাদের ওয়েবসাইটের  ঠিকানায়। বিস্তারিত পরিকল্পনা পাওয়া যাবে এই লিংকে  ।

এছাড়া আমরা ফেসবুকে একটা ইভেন্ট খুলেছি, সেখানেও ঢু মারতে পারেন। ভিজিট করতে পারেন মুনির স্যারের ব্লগে

 

আমরা স্বপ্ন দেখি, স্বপ্ন দেখাতে ভালবাসি। পাগলের দল পাগলামি করেই লাল-সবুজের পতাকা উড়াই।